– আজিজুর রহমান –
সাউথ আফ্রিকায় বসবাসকারী সিলেট প্রবাসীদের জন্য ২৩ জুন ছিল একটি মধুময় দিন, স্মৃতি রোমন্থনের দিন, পারস্পরিক ভালোবাসা ও সম্পৃতি বিনিময়ের দিন। এমন মাহেন্দ্রক্ষণ জীবনে খুব কমই আসে। পূর্ব নির্ধারিত ভেন্যু ইউনিভার্সিটি অব জোহানেসবার্গ হকি ক্লাব মাঠে এই মিলনমেলা অনুষ্ঠিত হয়।
ঈদ পূণর্মিলনী ও শীতকালীন পিঠা উৎসব নামের এ অনুষ্ঠানের আয়োজক ছিল সিলেট এসোসিয়েশন অব সাউথ আফ্রিকা। ভোর থেকেই কাছের ও দূরের শত শত আগত সিলেটবাসীর পদচারনায় মুখরিত ও প্রানবন্ত হয়ে ওঠে উৎসবস্থল।
জাতীয় সংগীত পরিবেশন ও বেলুন উড়িয়ে অনুষ্ঠানের শুভ সূচনা হয়। বেলুনগুলো যখন আকাশপানে চলে যাচ্ছিল তখন অনেককে বলতে শুনা যায় “যাহ যাহ ছিলট যা”। জানিনা বেলুনগুলো সিলেটবাসীর এ আবেগ ও অনুভুতিগুলো পূন্যভূমি সিলেট পর্যন্ত পৌঁছে দিতে পেরেছে কি না?
উৎসব মাঠে পৌঁছেই যেন মনে হল সিলেট পৌঁছে গেছি। এ যেন এক টুকরো সিলেট। চারদিকে পাহাড় টিলা আর সবুজ বন বনানীতে আবৃত মধ্যখানে এক মায়াবী মাঠ। যেমনটি আজন্ম দেখেছি আমার প্রিয় সিলেটকে। পূর্ব পরিচিত অনেকের সাথে অনেকদিন পর সাক্ষাৎ হলো। আবার নতুন অনেক ভাইদের সাথে পরিচয় হলো। ডি’আর থেকে আসা নজরুল ভাই ও হারুন ভাই দেখা দেখামাত্রই ঝাপটে ধরে বুকে টেনে নিলেন। নজরুল ভাইতো বলেই ফেললেন- “আজিজ ভাই আফনেতো দেখি আগ থাকি আরও জোয়ান অইগেছইন”।
শুভ্র সফেদ দাড়িভরা মুখ নিয়ে হেনোভার থেকে এসেছেন সকলের প্রিয়মুখ শফিক উদ্দিন (নানা ভাই)। নানা ভাইর ভাবখানা এমনই যেন বার্ধক্যকে জয় করে তরুনদের সাথে পাল্লা দিতে এসেছেন। বুকে জড়িয়ে নিয়ে বল্লেন “আপনে তো দেখি আমার লাখান বুড়া অইজিরা”। নানা ভাইর কথায় বড্ড মজা পেলাম।
পরিচয় হলো আরেক হারুন ভাইর সাথে। অসুস্থ শরীর নিয়ে ইস্টার্ণকেপ থেকে এসেছেন বিমান যোগে। সিলেট প্রেমের আকুলতায় কোন বাধাই তাকে আটকিয়ে রাখতে পারেনি। আচ্ছা বলুনতো কতটুকু প্রেম ভালোবাসা, আত্মার ব্যাকুলতা আর নাড়ীর টান থাকলে মানুষ এমনটি করে? এই সিলেটপ্রেম পৃথিবীর কোন দামী মূদ্রা দিয়ে কি কেনা যায়??
সংগঠনের সন্মানিত আহ্বায়ক সহ অনেক সিনিয়র ও জুনিয়র নেতৃবৃন্দ বুকে জড়িয়ে বল্লেন “আপনে তো আমরার হোয়াট্স্অ্যাপ গুরুফও যে সুন্দর সুন্দর লেখা দেইন”। সবার কথা শুনে অনেকটা লজ্জিত হলাম কিন্তু মনে মনে সবার কথায় প্রীত হলাম।
এখানে সিলেটের কমলা লেবু বা সাতকরা নেই। তবে অনেক জায়গায় পান-সুপারী পাওয়া যায়। আমি ভাই পানখোর মানুষ। অনুষ্ঠানে যাওয়ার সময় বেশ কিছু পান সুপারী নিয়ে গেলাম।পানখোরদের আবার মুখ দেখলেই চেনা যায়। আমার মুখ দেখেই অনেক পানখোর ভাই কাছে আসতে শুরু করলেন। সবার সাথে অল্পসময়ে সখ্যতা গড়ে উঠল। অনেকক্ষণ চল্লো পান খাওয়ার আড্ডা। নিজের কাছে নিজেকে বেশ পরিতৃপ্ত মনে হলো।
মাঠের একপাশে পিঠাপুলির স্টলগুলোতে সবাইকে যেন হুমড়ি খেয়ে পড়তে দেখলাম। নিপুন হাতে আমার বাংলাদেশী বোনেরা বাহারী রঙের রকমারী পিঠার সম্ভার ডিসপ্লে করে রেখেছেন। সবাই ধুমধাম করে পিঠা খাচ্ছেন। আমিও লোভ সামলাতে পারলামনা। একদিনের জন্য ডায়াবেটিসকে ভুলে গেলাম। তৃপ্তি মিটিয়ে সুস্বাদু পিঠা দিয়ে উদর ভর্তি করলাম। সাথে সাথে মনে পড়ে গেল আমার আদরের দুই সন্তান তানিশা ও আবিরের কথা। এই মুহূর্তে ওরা কছে থাকলে মিষ্টিদ্রব্য খাওয়ার অপরাধে বড়সড় একটা শাসন চলতো আমার উপর দিয়ে।
একসময় মাইকে জোহরের আযান হলো। সাউথ আফ্রিকার একটি নামীদামী ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দারুল উলুম জাকারিয়ার কৃতি শিক্ষার্থী স্নেহভাজন মৌলানা আবুল খায়ের তাহের-এর ইমামতীতে আমরা সবাই সবুজ ঘাসের গালিচায় নামাজ আদায় করলাম।
অত:পর চমৎকার একটি দুপুরের খাবার পরিবেশন করা হলো। দিনব্যাপী পুরুষ, মহিলা ও ছোট ছেলেদের বিভিন্ন খেলধুলা ও প্রতিযোগিতা চলতে লাগলো। সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও ভাল লাগলো শিশুকিশোরদের কোলাহল, দৌড় ঝাপ, হাসি খুশি আর হই হুল্লোড়। শৈশব কৈশোরের দুরন্তপনা আর মিষ্টি মধুর কলরবে সারাদিন তারা মাতিয়ে রাখলো উৎসবের মাঠ। এ যেন স্বপ্নে দেখা সাউথ আফ্রিকার মাটিতে প্রবাসীরা এক ঝাক মুক্ত বিহঙ্গ প্রান উজাড় করে খেলা করছে।
আমাদের সন্মানিত বয়োবৃদ্ধদের দেখলাম দলে দলে দাড়িয়ে খুশগল্পে মশগুল আছেন। অনেকে আবার মিষ্টি রোদ গায়ে মেখে ফুরফুরে মেজাজে অনুষ্টান উপভোগ করছেন।
যুবক এবং তরুনেরা তো রীতিমতো পেরেশান। আগত সিলেটবাসী তথা অন্যান্য জেলার অতিথিদের কিভাবে সন্তুষ্ট ও খুশি রাখা যায় তাই নিয়েই তাদের ব্যস্ততা। সিলেটবাসীর অতিথি পরায়নতা সর্বজন বিদিত। সিলেটের যুবকেরা তা আরেকবার প্রমান করে দিলেন। পরিবেশটা এমনই ছিল যেন সবাই মেহমান বা অতিথি কিন্তু কেউই যেন মেহমান বা অতিথি নন; সবাই আয়োজক কিন্তু কেউই যেন আয়োজক নন। মিলে মিশে সবাই একাকার হয়ে গেছেন। সবার যেন একটাই উদ্দেশ্য- সকলের পরম সন্তুষ্টি। এখানে আরেকটি বিষয় দেখলাম সিলেটি নয় এমন অনেক ভাতৃপ্রতিম সংগঠনের নেতৃবৃন্দ ও যুবকেরা এসেছেন। তারাও আমাদের সাথে একিভুত হয়ে গেলেন।স্বপ্রনোদিত হয়ে স্বেচ্ছাসেবকের দায়িত্ব পালন করছেন, আনন্দ উপভোগ করছেন। সত্যিই অনেক মনোমুগ্ধকর ছিল এসব পরিবেশ।
পড়ন্ত বিকেলে কনকনে শীতে শুরু হলো পুরস্কার বিতরন ও আলোচনা সভা। সংগঠনের সদস্য সচিব স্নেহ প্রতিম নোমান মাহমুদের সঞ্চালনায় এবং সন্মানীত আহবায়ক এসএম ইসলাম সেরুলের সভাপতিত্বে এতে ভার্চুয়াল বক্তব্য দেন প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রনালয়ের মাননীয় প্রতিমন্ত্রী শফিকুর রহমান চৌধুরী এমপি, সিলেট সিটি মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী, সাবেক মেয়র জনাব আরিফুল হক চৌধুরী ও শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল এমপি মহোদয়। এছাড়াও অন্যান্য সংগঠনের নেতৃবৃন্দ, ভাতৃপ্রতিম অন্যান্য সংগঠনের নেতৃবৃন্দ, ব্যবসায়িক নেতৃবৃন্দ মুক্তিযোদ্ধা, রাজনীতিবিদ ও অন্যান্য গন্যমান্য ব্যক্তিবর্গ তাদের মূল্যবান বক্তব্য প্রদান করেন।
একটি অথেনটিক ও মনোমুগ্ধকর সুন্দর অনুষ্ঠান উপহার দেয়ার জন্য সিলেট এসোসিয়েশন অব সাউথ আফ্রিকাকে অকৃত্রিম ধন্যবাদ। সবার জন্য অবিরাম ভালোবাসা ও শুভ কামনা।
কবি যেমন প্রজাতির প্রেমে পড়ে বলেছিলেন “ওলী ফিরে আয়, বার বার ফিরে আয়”। আমিও তেমনি বলি আজকের এ মিলনমেলা আবার ফিরে আসুক, বারবার ফিরে আসুক।
লেখক: আজিজুর রহমান (আজিজ)
যুগ্ম সম্পাদক, সিলেট এসোসিয়েশন অব সাউথ আফ্রিকা।